আরণ্যকের জন্মকথা

১৯৭২ সনের ফেব্রুয়ারিতে আরণ্যক নাট্যদলের জন্ম। এদেশের প্রেক্ষাপটে একদিকে তখন শেকলছেঁড়া মুক্তির আনন্দ; অন্যদিকে জনগণের দীর্ঘলালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের একাগ্র আকাক্সক্ষা। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তখন পুনর্গঠনের পালা; জন্ম নিচ্ছে নতুনতর মূল্যবোধ। যে নাটকে এদেশের সংঘ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রক্তাক্ত জীবনসংগ্রাম মূর্ত, সে নাটক করার অঙ্গীকার নিয়েই আরণ্যক তাদের প্রথম প্রযোজনায় হাত দেয়। আরণ্যকের প্রথম প্রযোজনা নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’। কবর’র মধ্যেদিয়েই আরণ্যকের ভবিষ্যৎ চিত্রটি ফুটে ওঠে। কেননা শুরু থেকেই আরণ্যক মনে করে একজন নাট্যকর্মী শুধুমাত্র অভিনেতাই নয়, সে সমাজের সুস্থ চেতনার অধিকারীদেরও একজন এবং নাটক যেখানে সমাজ বিকাশের একটি সহযোগী হাতিয়ার, সেখানে নাট্যকর্মের দ্বারা সমাজের বৈজ্ঞানিক বিকাশকেও তরান্বিত করা সম্ভব । কবর’র পর সে বছরই অভিনীত হয় ‘পশ্চিমে সিঁড়ি’। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে, বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক বঞ্চনার ওপর ভিত্তি করে পশ্চিমের সিঁড়ি একটি রূপকধর্মী নাটক হিসেবে মঞ্চে আসে। কিন্তু মাত্র দুটি প্রদর্শনীর পর এ যাত্রায় ছেদ পড়ে। এরপর বিরতি প্রায় তিন বছরের। ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে ’৭৫-এর শেষের দিকে শ্রেণিসংগ্রামের একটি বিমূর্ত ধারণাকে কেন্দ্র করে পুনর্বার জেগে ওঠে আরণ্যক ‘গন্ধর্ব নগরী’কে নিয়ে। ‘গন্ধর্ব নগরী’ নাটকীয়তা এবং শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কিত অস্পষ্ট ধারণার নাটক। প্রকৃত অর্থে আরণ্যকের বক্তব্য এবং দৃষ্টিভঙ্গীর স্বচ্ছ ও সরাসরি প্রতিফলন ঘটে ‘ওরা কদম আলী’তে এসে। সুনির্দিষ্ট মানবিক মূল্যবোধে, শ্রেণিসংগ্রাম আর প্রতিরোধের চেতনায় উদ্দীপ্ত ছাড় ‘ওরা কদম আলী’, একাধিক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৭৯ সালে আরণ্যকের প্রযোজনা ‘ওরা আছে বলেই’। গ্রাম থেকে ভেসে আসা মানুষের সংঘবদ্ধ টিকে থাকার সুসংগঠিত চিত্র ‘ওরা আছে বলেই’। যষ্ঠ প্রযোজনা ‘ইবলিশ’। প্রযোজনার মান ও বক্তব্য বিচারে ইবলিশ অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও উচ্চাকাক্সক্ষী নাটক। বাংলাদেশকে এখানে ধরা হয়েছে একটি বৃহৎ গ্রাম হিসেবে। ইবলিশের প্রযোজনায় দুটি নতুন জিনিস চোখে পড়ে; একটি, গ্রামীণ সমাজবিন্যাসের তীব্র বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ; অন্যটি গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার পাকে পাকে সাদা আলখাল্লা ঢাকা মোল্লাদের নিষ্ঠুর দৌরাত্ম।

সর্বমোট দশ বছরে (১৯৭২-’৮২) ‘কবর’ থেকে ‘ইবলিশ’ পর্যন্ত আরণ্যক প্রযোজিত নাটক প্রদর্শনীয় সংখ্যা ১৭৮টি। এই এক দশকের নাট্যচর্চার অভিজ্ঞতায় আরণ্যক একটি নির্দিষ্ট উপলব্ধিতে পৌঁছয়। এই উপলব্ধি যে, মহিলা সমিতির সীমিত আসনের মঞ্চে নাটককে কখনোই প্রচলিত বিনোদনের কনসেপ্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। অভিনেতা ও মঞ্চতৃপ্ত মধ্যবিত্ত দর্শকের মধ্যকার সুগভীর বিচ্ছিন্নতাটুকু থেকেই যাবে। সুতরাং প্রয়োজন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকের; সহজতর ও জীবনঘনিষ্ঠ কোন আঙ্গিক। এ উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় মুক্ত নাটকের ধারণা।

মুক্ত নাটকের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আরণ্যক মঞ্চে আনে আবাদুল্লাহেল মাহমুদ রচিত ‘সাত পুরুষের ঋণ’। এরপর দেশে সামরিক শাসন ও মধ্যবিত্তের সংকট নিয়ে মামুনুর রশীদ রচনা করেন ‘গিনিপিগ’। সমকালীন রাজনীতির সাথে তৃতীয় বিশে^র গিনিপিগ সদৃশ জনতার আশা-আকাক্সক্ষার সংগ্রাম মূর্ত হয়ে উঠলো এ নাটকে। গিনিপিগ এর পর স্বল্পকালের জন্য এলো ‘অববাহিকা’। অববাহিকা এই জনপদের সমকালীন সুখ-দুঃখের চালচিত্র। ১৯৮৬ সালে মঞ্চে এলো ‘নানকার পালা’। আরণ্যকের নাট্যর্চার আরেকটি পালা বদল। কৃষক বিদ্রোহের উপর নির্মিত নাটকটি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। নানকার পালা মঞ্চে আসার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা আর স্বৈরাচারী নির্যাতনের কালে ব্যাহত হলো স্বাভাবিক নাট্যচর্চা। এ সময় আরণ্যক মঞ্চ ছেড়ে নেমে এলো পথে। মিছিল, বিক্ষোভ আর পথনাটক এক হয়ে গেল।

‘নানকার পালা’র পর মঞ্চে আসে মানবিক আবেগ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণের নাটক ‘সমতট’। বিগত নাটকের উচ্চকিত সুরের জায়গায় পরিশীলিত হয়ে এলো শিল্পবোধ এবং নির্মাণ কৌশল। সমতট পরবর্তী প্রযোজনা শেক্সপিয়ারের ‘কোরিওলেনাস’। নাটকটি অনুবাদ করেন মান্নান হীরা। কোরিওলেনাস বিশ^নাট্য পরিক্রমায় আরণ্যকের প্রথম পদচারণা।

ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে গেছে অনেক প্রলয়কাণ্ড। সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয়, সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির নবতর উত্থান বিশ^কে টালমাটাল করে তোলে। শুরু হয় বিশ^ রাজনীতির নতুন খেলা। এই নিয়ে মঞ্চে এলো রাজনৈতিক প্রহসন ‘খেলা খেলা’। এর পর মামুনুর রশীদের ‘পাথর’। উপমহাদেশের বাস্তবতাকে নিয়ে এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দলিল। এমনই সময়ে বিশ^জুড়ে এবং বাংলাদেশেও চলছে বিপ্লবী মানুুষদের মরণ লড়াই। বিপ্লবের কোন পথটি সঠিক তাই নিয়ে নানা বিতর্ক, দলগুলির বিভক্তি, কখনো কখনো আত্মঘাতী ঘটনা-অথচ আপোষহীন। এরই এক উপাখ্যান মান্নান হীরা’র ‘আগুনমুখা’। আগুনমুখা’র পর মঞ্চে নিয়ে আসেন মামুনুর রশীদ তার বহুল প্রশংসিত নাটক ‘জয়জয়ন্তী’। এ নাট্যখান মুক্তিযুদ্ধের, স্বাধীনতার, মুক্তির ও জাগরণের। সংগীত, বাদ্যযন্ত্র ও অভিনয়ের এক নিপুণ কবিতা হয়ে উঠলো ‘জয়জয়ন্তী’। তারপর আবার মঞ্চে এলো ভিন্ন রঙ। সহস্র বৎসর পূর্বের ইতিহাসের এক বিশেষ ক্রান্তিকালকে তুলে আনলেন আব্দুল্লাহেল মাহমুদ ‘প্রাকৃতজনকথা’ নাটকে। এ নাটক মঞ্চে আসে ১৯৯৭ সালে। ২০০১ সালে আরণ্যক মঞ্চে নিয়ে আসে মান্নান হীরা রচিত ‘ময়ূর সিংহাসন’। মহান মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে একটি মফস্বল শহরে স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরোধ এ নাটকের প্রতিপাদ্য। একই সাথে মঞ্চে উঠে আসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন ও শিল্পীর জীবন পেশার সংকট।

এরপর ‘সঙক্রান্তি’। গ্রামের লোকনাট্যের একটি আঙ্গিক সঙ। তার সাথে সম্পর্কিত কৃষিজীবি মানুষের জীবন ও শিল্পের বিরোধ এবং উচ্চবিত্ত মানুষের কাছে তারে অবহেলা যা তাদের জীবনও জীবীকাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। এই প্রতিপাদ্য নিয়ে সঙক্রান্তি। ‘রাঢ়াঙ’-দূরাগত মাদলের ধ্বনি। বাংলাদেশের এক আদিবাসী সম্প্রায় সাঁওতাল-তাদের ভূমিলুণ্ঠন ও নিপীড়নসহ নানা নির্যাতনের এক মহাকাব্যিক প্রযোজনা ‘রাঢ়াঙ’ আরণ্যককে জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্থান করে দেয়। এরপর ‘উপরওয়ালা’। ইবসেন উৎসবে অভিনীত হয় নাটকটি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভারতের এক পরিচিত নাম। একাধারে সমাজসেবী, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক। তাঁর আজীবন সংগ্রাম বিধবা বিবাহ প্রচলন আজও ইতিহাস হয়ে আছে। তারই জীবন ও গল্প নিয়ে ২০০৮ সালে মঞ্চে আসে ‘এবং বিদ্যাসাগর’। এরপর মঞ্চে আসে ‘শত্রুগণ’। মামুনুর রশীদ তার রচনায় তুলে আনেন দেশের অভ্যান্তরে সাম্রাজ্যবাদের অনুচর হিসেবে বিদেশি ঋণ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করে কীভাবে তাদের শোষণের জালে বেঁধে ফেলা হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের উত্থান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। একইসাথে শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষ করে অবহেলিত নারীদের স্বাধীন পেশা হিসেবে পোশাক শিল্পে অংশগ্রহণ একটি সামাজিক বিপ্লব। অথচ মালিক শ্রেণির অবহেলায় নানাভাবে নানা দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত হচ্ছে শতশত শ্রমিক। তারই এক নির্মম চিত্র আরণ্যকের ‘স্বপ্নপথিক’। হারুন রশীদ রচিত ‘স্বপ্নপথিক’ সমকালীন জাতীয় জীবনের এক অশ্রুমিশ্রিত আখ্যান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত বার্ষিকী উদ্যাদিত হলো কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আরণ্যক মঞ্চে আনে মামুনুর রশীদের ‘ভঙ্গবঙ্গ’। ১৯০৫ সালের ভঙ্গবঙ্গ আন্দোলনের সাথে আজকের সময়কে সমন্বয় করে রূপকধর্মী নাটক ভঙ্গবঙ্গ। দেশে দেশে সীমান্ত কিভাবে মানুষ ও তার প্রেমকে দ্বিখণ্ডিত করেছে তারই এক কাব্যিক প্রযোজনা ‘ভঙ্গবঙ্গ’। এরপর ২০১৬ সালে মঞ্চে আসে মান্নান হীরা রচিত ‘দি জুবলী হোটেল’। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, হত্যা, গুম, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন এবং সর্বোপরি জঙ্গিবাদের উত্থানের নানা গল্পকেক এক সুতোয় বেঁধে নির্মিত হয়েছে ‘দি জুবলী হোটেল’।

সর্বশেষ আরণ্যক মঞ্চে আনে ‘কহে ফেসবুক’। মানুষের দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে ইন্টারনেট তৈরি করেছে এক অদৃশ্য জগৎ। এর ব্যপ্তি এবং ঘাত এতটাই তীব্র যে এর প্রভাবে মানুষ পরিণত হয়েছে এক জৈবিক রোবটে। এমন ভাবনা নিয়েই নির্মিত হয়েছে নাটকটি।

এই মঞ্চনাটকগুলোর বাইরেও আরণ্যকের পদচারণা বহু বিস্তৃত। আরণ্যক দেশের যে-কেনো রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয়। তারই অংশ হিসেবে আরণ্যক ১৯৮২ সাল থেকে পথনাটক রচনা প্রযোজনা ও অভিনয় করে আসছে। স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, গণতন্ত্র বিনষ্টকারী শক্তির বিরুদ্ধে আরণ্যক সদা সোচ্চার। একইসাথে যেকোনো সামাজিক অপরাধে পথনাটকের প্রযোজনা নিয়ে দেশে ও বিদেশের নানা স্থানে ছুটে বেড়ায় আরণ্যক। আরণ্যকের নাট্যদলের জন্ম ও লক্ষ্য শোষণের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করা। সে ক্ষেত্রে পথনাটকের ভূমিকা অসমান্য।